ঈশা খাঁর জঙ্গলবাড়ি দূর্গ, কিশোরগঞ্জ
ঈশা খাঁর জঙ্গলবাড়ি দূর্গ
মুসলিম বীর ঈশা খাঁর কথা জানে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেননা, আজকাল বিভিন্ন পাঠ্য পুস্তকেও ঈশা খাঁর বীরত্ব ও ইতিহাসের কথা উঠে এসেছে।মসনদে-আলা-বীর ঈশা খাঁ এক প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন। তাঁর মূল বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনাগাঁওয়ে অবস্থিত। কিন্তু সেটি ছাড়াও তাঁর আরো একটি ঘাঁটি ছিল কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার জঙ্গলবাড়িতে। এটা বীর ঈশা খাঁর দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে প্রচলিত।
প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন ঈশা খাঁর জমিদারবাড়িটি এখনো পুরাতন জরাজীর্ন স্থাপনা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে এখন নেই সেই জৌলুস আর আভিজাত্য। শুধু রয়ে গেছে কিছু স্মৃতি চিহ্ন।
সেখানে গেলে জমিদারবাড়ির প্রাসাদসম অট্টালিকা আজ আর চোখে পড়বে না। পাওয়া যাবে কালের স্বাক্ষী হয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা জরাজীর্ণ একটি ভবন, দরবারগৃহ, পুকুরঘাট ও মসজিদ। ঈশা খাঁর এই বাড়িটি দেখতে প্রতিদিনই দেশি-বিদেশি পর্যটক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ভীড় লেগে থাকে।
ঈশা খাঁ সম্পর্কে : ইতিহাসে ঈশা খাঁ সম্পর্কে যা পাওয়া যায় তা হলো, তিনি ১৫২৯ সালের ১৮ আগস্ট জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সোলায়মান খাঁ। তিনি ছিলেন আফগানিস্তানের সোলায়মান পার্বত্য অঞ্চলের এক আফগান দলপতির বংশধর। নুসরত শাহ এর রাজত্বকালে তিনি বাংলায় বসতি স্থাপন করেন এবং স্বীয় প্রচেষ্টায় ভাটি এলাকার বৃহত্তর ঢাকার ও ময়মনসিংহ জেলার উত্তর-পূর্ব অংশ নিয়ে এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
সোলায়মান খাঁ অন্ততপক্ষে দুবার ইসলাম শাহ শুরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং ১৫৪৮ সালে নিহত হন। ঈশা খাঁর বয়স তখন ১৯ বছর। পিতার মৃত্যুর পর ঈশা খাঁর পিতৃব্য কুতুবউদ্দীন তাকে লালন পালন করেন। তখন বাংলার জমিদারগণ মোঘল ও ইংরেজদের কবল থেকে বাংলাকে রক্ষা করার জন্য তাদের গোয়েন্দাদের মাধ্যমে ঈশা খাঁকে আফগানিস্তানে সংবাদ দিয়েছিলেন।
ঈশা খাঁ তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে আফগানিস্থান হতে ১৪০০ (চৌদ্দশ’) অশ্বারোহী, ২১টি নৌবিহার ও পর্যাপ্ত গোলা বারুদ নিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যে এসে পৌঁছান। ত্রিপুরা রাজ্য থেকে কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি দূর্গ দখল করে পরবর্তীতে সোনারগাঁও দূর্গ দখল করেন। তিনি তাঁর যৌবন ভাটিতে কাটিয়েছিলেন। সোনারগাঁওয়ের প্রাচীন নাম ছিল সুবর্ণ গ্রাম। ঈশা খাঁ ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা চাঁদরায়ের কন্যা-কেদার রাজার বোন স্বর্ণময়ীকে বিবাহ করেন। স্বর্ণময়ী পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ঈশা খাঁ তার নাম রাখেন সোনা বিবি। সেই নাম অনুসারে বাংলার রাজধানী সোনারগাঁও নামকরণ করা হয়।
কররাণী আফগান শাসক তাজ খানের অনুগ্রহে ৩৫ বছর বয়সে ঈশা খাঁ বাংলার কররাণী শাসকের সমান- হিসাবে সোনারগাঁও ও মহেশ্বরদী পরগনায় ১৫৬৪ সালে ভিনদেশী হিসেবে তিনগুণ মোহর দিয়ে জমিদারি লাভ করেন। তিনি ১৫৭১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এত শক্তিশালী হয়ে উঠেন যে, আবুল ফজল তাকে ভাটির শাসকরূপে আখ্যায়িত করেন। ১৫৭৫ সালে তিনি সোনারগাঁওয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে মোঘল নৌবহরকে বিতাড়িত করতে দাউদ খানের সেনাপতিকে সাহায্য করেছিলেন। দাউদ খানের প্রতি কর্তব্য পালনের প্রতিদানে তিনি মসনদ-ই-আলা উপাধি লাভ করেন।
ষোড়শ শতাব্দীতে মোঘলদের হাত থেকে বাংলাকে রক্ষার জন্য বার ভূঁইয়াদের নেতা ঢাকা সোনারগাঁওয়ের বিচক্ষণ ও দূরদর্শী রাজনীতিবিদ সু-শাসক ঈশা খাঁ (মসনদ-ই-আলা) মোঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহকে পরাজিত করে ১৫৯৭ সালে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা করেছিলেন। তখন থেকে সোনারগাঁওকে কেন্দ্র করে স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলার স্বাধীনতার বীজ একমাত্র ঈশা খাঁ বপন করেছিলেন। তার সাহস, বীরত্ব, দেশপ্রেমিকতা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
ষোড়শ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে মোঘল সাম্রাজ্যবাদ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার্থে ঈশা খাঁর সফল সংগ্রাম তাকে বাংলার প্রধান ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। তিনি তার সোনারগাঁও ও মহেশ্বরদীর জমিদারীকে সাফল্যের সঙ্গে এক স্বাধীন রাজ্যে পরিণত করেন।
এ রাজ্য বৃহত্তর ঢাকা বেশ কিছু অংশ, প্রায় সমগ্র বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা এবং ত্রিপুরা জেলার এক ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে গঠিত হয়। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের খিজিরপুর এবং কিশোরগঞ্জ জেলার জঙ্গলবাড়ি ও এগারসিন্দু ছিল তার শক্তিশালী ঘাঁটি।
ঈশা খাঁর বিদায় পর্ব : ঈশা খাঁ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিভিন্ন দূর্গে যাতায়াত করতেন। ১৫৯৯ সালে মহেশ্বরী পরগনার অন্তর্গত বক্তারপুর দূর্গে গিয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৫৯৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রায় ৭০ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন করেন তিনি। গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ থানায় বক্তারপুর গ্রামে ঈশা খাঁ সমাহিত আছেন।
উত্তরাধিকারদের বর্তমান অবস্থা : ঈশা খাঁর মৃত্যুর পর তার ছেলে প্রথম বংশধর মুসা খাঁ বাংলার ভাটি অঞ্চলের (পূর্ব বঙ্গ ব-দ্বীপ) অধিপতি হন। ১৫৯৯ সালে পিতার মৃত্যুর পর তিনি এক বিশাল রাজ্যের উত্তরাধিকারী হন। এ রাজ্য বৃহত্তর ঢাকা ও কুমিল্লা জেলার প্রায় অর্ধেক, প্রায় সমগ্র বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা এবং সম্ভবত বৃহত্তর রংপুর, বগুড়া ও পাবনা জেলার কিছু অংশে বিস্তৃত ছিল। মুসা খাঁ এক শক্তিশালী নৌ-বাহিনীর অধিকারী ছিলেন। রাজধানী সোনারগাঁও ছাড়াও খিজিরপুর, কাত্রাবো, কদম রসুল, যাত্রাপুর, ডাকচর, শ্রীপুর ও বিক্রমপুর তার দুর্ভেদ্য সামরিক ঘাঁটি ছিল। অপরাপর ভূইয়াদের সহায়তায় পূর্ব বঙ্গের স্বীয় আধিপত্য অক্ষুণ্ন রাখার জন্য তিনি ১০ বছর ধরে মোঘল বাহিনীর বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু বারবার পরাজয় এবং সোনারগাঁওসহ তার ঘাঁটিগুলো পতনের ফলে শেষ পর্যন্ত ১৬১১ সালে তিনি মোঘলদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হন। মুসা খাঁ ১৬২৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা মুসা খাঁ মসজিদের সন্নিকটে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শহীদুল্লাহ হল প্রাঙ্গণে) তিনি সমাহিত আছেন।
মুসা খাঁর মৃত্যুর পর তার ছেলে ফিরোজ খাঁ দ্বিতীয় বংশধর পরগনার অধিপতি হন এবং তার মৃত্যুর পর মনোয়ার খাঁ (৩য় বংশধর) পরগনার অধিপতি হন। পরবর্তীতে তাদের বংশধর হত্তু খাঁ, নত্তু খাঁ, পাহাড় খাঁ (৪র্থ বংশধর) এবং পাহাড় খাঁর ছেলে চামরু খাঁ (পঞ্চম বংশধর) এবং অন্যান্য বংশধররা সোনারগাঁওয়ে অবস্থানকালীন ১৭৭০ সালের দিকে তৎকালীন শাসক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেই ঐতিহাসিক সোনারগাঁও দখল করে এবং সোনারগাঁও থেকে ঈশা খাঁর চতুর্থ ও পঞ্চম বংশধরদের বিতাড়িত করেন।
চতুর্থ ও পঞ্চম বংশধররা প্রাণের ভয়ে ঘোড়া ও বড় বড় নৌকাযোগে বাংলাদেশের সুদূর দক্ষিণে সুন্দরবনের ধারে সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ থানার মহৎপুর গ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে যাওয়ার পর তারা সঙ্গে নিয়ে যাওয়া মোহর দিয়ে অনেক ভূমি খরিদ করেন এবং নতুনভাবে ইমরত তৈরি করেন। সেই সময় হতে বাড়িটি খাঁ বাড়ি বলে পরিচিত। ঐ সময় থেকে তারা সেখানে স্কুল, কলেজ, ঈদগাহ, মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান ইত্যাদি তৈরি করেন।
চামরু খাঁর ছেলে তালেব খাঁ (৬ষ্ঠ বংশধর), তালেব খাঁর ছেলে আজিজাত খাঁ, চন্দন খাঁ, শাহাদৎ খাঁ, আমানতউল্লাহ খাঁ (৭ম বংশধর), শাহাদৎ খাঁর ছেলে ছবিলার রহমান খাঁ (৮ম বংশধর), ছবিলার রহমান খাঁর ছেলে নজিবর রহমান খাঁ, মেয়ে স্বপ্না নাসরিন ও নাছিমা সুলতানা রত্না (১০ম বংশধর)। নাসিমা সুলতানা রত্না ঈশা খাঁ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তিনি কবি, ইতিহাসবিদ ও সমাজ সেবক ছিলেন।
সর্বশেষ জঙ্গলবাড়ির এ বাড়িটিতে বসবাস করতেন ঈশা খাঁর ১৪তম বংশধর দেওয়ান ফতেহ আলী দাদ খাঁ। ২০১৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। বর্তমানে তাঁর ছেলে দেওয়ান মামুন দাদ খাঁ পরিবার পরিজন নিয়ে কিশোরগঞ্জ শহরের রথতলা এলাকায় বসবাস করেন।
বর্তমান চিত্র : বীর ঈশা খাঁর স্মৃতি বিজড়িত জঙ্গলবাড়িটি কিশোরগঞ্জ শহর থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে করিমগঞ্জ উপজেলার নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত। বনজঙ্গল ঘেরা এক স্থানটি ‘জঙ্গলবাড়ি’ নামে পরিচিত। এ এলাকাটিই বারভুঁইয়ার নেতা, ভাটি রাজ্যের অধিপতি মসনদে-আলা ঈশা খাঁর দ্বিতীয় রাজধানী। তিনি এটাকে দুর্গ হিসেবেও ব্যবহার করতেন।
নিকট অতীতে ২০০৫ সালের ১২ জুন, এখানকার দরবারগৃহটি ঈশা খাঁ স্মৃতি যাদুঘর ও পাঠাগার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার কে. এম রুহুল আমিন, উপজেলা সমাজসেবা অফিসার কামরুজ্জামান খান ও চেয়ারম্যান এবিএম সিরাজুল ইসলাম এই উদ্যোগ নেন।
তবে বর্তমানে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কেবল উত্তর-দক্ষিণে লম্বা ইটের পাঁচিল দিয়ে ভাগ করা দুটি চত্বর অবশিষ্ট আছে। স্থানীয়দের নিকট পাঁচিলটি ‘প্রাসাদ প্রাচীর’ নামে পরিচিত। দক্ষিণ প্রান্তে রয়েছে আরো একটি তোরণ। তোরণটির সামেনে ‘করাচি’ নামে পরিচিত একটি পূর্বমূখী একতলা ভবন আছে। উত্তরে রয়েছে একটি তিনগম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। তোরণের পেছনে ‘অন্দর মহল’ নামে এক তলা দক্ষিণ মুখী একটি ভবন। গোটা ইটের দেওয়াল চুনকামসহ লেপন দিয়ে ঢাকা।
সামনেই রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বেশ বড় একটি পুকুর। মোগল প্রথাসিদ্ধ রীতির ছাপ মসজিদটির প্রতিটি ইটের গায়ে ও স্থাপত্যে চিহ্ন রেখে গেছে। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ২০০৯ সাল থেকে ঈশা খাঁর স্মৃতি বিজড়িত জঙ্গলবাড়িটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে। এর পর থেকে এই অধিদপ্তরই এই ‘জঙ্গলবাড়িটি সংরক্ষণের দায়িত্বে আছে।
কিশোরগঞ্জ ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক লেখক ও গবেষক আমিনুল হক সাদী বলেন, ‘মসনদে-আলা- ঈশা খাঁর দ্বিতীয় রাজধানী জঙ্গলবাড়ির দূর্গ নগরী ও হাবেলী সংস্কার না হওয়ায় আজ তা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। তবে সম্প্রতি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর তা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ায় বেশ আশান্বিত হয়েছি। হয়ত ইতিহাস বিজড়িত এই ‘জঙ্গলবাড়িটি’ আগামী প্রজন্মের জন্য রক্ষা করা সম্ভব হবে।’
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রাক্তন আঞ্চলিক পরিচালক, বর্তমানে উপ-পরিচালক (প্রকাশনা) ড.মো. আতাউর রহমান জানান, বাড়িটিকে সংস্কার করে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হবে এবং এলাকাটিকে প্রত্নপল্লী হিসেবে গড়ে তোলা হবে। শিগগিরই সংস্কার কাজ শুরু হবে। কাজটি সম্পন্ন হলে এখান থেকে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া আশা করা যায়, দেশি-বিদেশি পর্যটকরাও এখানে পরিদর্শণে আসবেন।
তথ্যসূত্র : বিভিন্ন গ্রন্থ এবং স্থানীয় অধিবাসী
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন